যে ঘণত্বের প্রান্ত নেই
শাইখুল হাদিস শিহাব উদ্দিন রাহিমাহুল্লাহ |
১.
জাতির চেতনার শেকড়ে যারা জল ঢালেন। যারা সভ্যতার মেরুদন্ড সুদৃঢ় করে দেন, গড়ে
তোলেন যোগ্য ব্যক্তি, আদর্শ সমাজ। দেশ ও
জাতিকে উপহার দেন নিষ্ঠাবান, সহিষ্ণু, উদার
চিন্তক নেতৃত্ব। যুগে যুগে যারা মুখ্য ভূমিকায়
থেকে গড়ে দেন জাতির পরিচয়। জীবনের প্রতিটি বাঁকের দিক-নির্দেশক স্মারক। এঁরা
আমাদের শিক্ষক।
সাধারণভাবে শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। এঁরা জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। একজন প্রাজ্ঞ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন
শিক্ষকের দ্বারা সত্যিকারভাবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা দেশ
ও জাতি উপকৃত হয়। শিক্ষকের হাতেই সূচিত হয় মানব সভ্যতার বিকাশ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ঐশী
জ্ঞান লাভ করেছেন, আল্লাহ প্রদত্ত সেই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার
ভিত্তিতে তিনি মানবজাতিকে স্রষ্টা, মানুষ ও প্রকৃতির
পারস্পরিক সম্পর্কের নীতিমালা শিক্ষা দান করে নিজের পরিচয় তুলে ধরে বলেছেন,
وإنما بُعِثت
مُعلمًا
‘নিশ্চয়
আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’
(سنن ابن ماجه : ٢٢٩)
অন্য একটি হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إن الله لم
يبعثني معنتا ولا متعنتًا، ولكن بعثني معلمًا وميسِّرًا
আল্লাহ্ তো আমাকে কঠোর ও কঠিন হৃদয়
দিয়ে পাঠান নি। তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন শিক্ষা দেওয়ার জন্য, সহজ করার জন্য।
(صحيح مسلم : ١٤٧٨)
শাইখুল হাদীস
আল্লামা শিহাবুদ্দীন রহ. ছিলেন ইলমে নববীর একজন সফল শিক্ষক। ওয়ারিসে নববীর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
শত শত মুহাদ্দিসীনে কেরামের এ উস্তাদ জীবনের সিংহ ভাগ উৎসর্গ করেছিলেন ছাত্রদের হাদীস
পাঠদানে, সাধারণ মুসলমানদের নসীহত ও দিক নির্দেশনায়। উম্মাহর কল্যানে এ মহান পুরুষ
নিজের পরিবার ও সন্তান-সন্তদিকেও দিতে পারেননি পর্যাপ্ত সময়। ফলে তাঁর কর্মমুখর জীবন
থেকে জাতি পেয়েছে জ্ঞানের অন্তহীন সমৃদ্ধি। আর এ ধারা অব্যাহত থাকবে কিয়ামত অবধি। ইনশাআল্লাহ।
২.
আমরা তাঁকে নির্লিপ্ত দেখতাম, ভাবতাম তিনি ভাবাবেগহীন। এরপর
যত দেখেছি হয়েছি বিস্মিত, যত কাছে গিয়েছি ততই হয়েছি আপ্লুত। এখনো মনে আছে সর্বপ্রথম যখন তাঁর হুজরায় গিয়ে ভয়ে ভয়ে সালাম নিবেদন করলাম, তিনি হাসছিলেন। মাথা অল্প নিচু
রেখে চোখ সামান্য তুলে তার সেই বিখ্যাত মুচকি হাসি। নিমিষেই সহজ হয়ে গেলাম। এ হাসিতে শুদ্ধতা ছিল। ছিল অস্ত্বিত্যের অর্থ
নিহিত।
আমরা দেখেছি হাদিসে সাহাবায়ে কেরামের ত্যাগের আলোচনা আসলে তিনি হতেন সাহাবা-প্রেমে বিগলিত। চোখ থেকে অশ্রু ঝরত। মুখের আওয়াজও কিছুটা পাল্টে যেত। বিষয়টি আমাদেরকে স্পর্শ করত। দ্বীনের জন্য সাহাবায়ে কেরামের সীমাহীন ত্যাগ স্বীকারের ব্যাপারটি তখন ভিন্নভাবে অনুভবে আসতো।
বুখারীর দরসে তাঁর আলোচনা দীর্ঘ হত, সেখানে ছিল এক ধরণের পরিমিতি-বোধ ও মধ্যপন্থা। হাদিসের ব্যাখ্যায়
তাওযিহাত-তাবিলাতের ফুলঝুরি ছুটাতেন না। মূল বিষয়টি
সযতনে বর্ণনা করতেন। ইজতেহাদী মাসআলায়
ভারসাম্যপূর্ণ আলোচনা করা খুবই মুশকিল। এ
ক্ষেত্রে আমরা কথার খেই হারিয়ে ফেলি। অনেক সময়
অন্যান্য মাযহাবের ইমামদের ব্যাপারে অসংলগ্ন কথা আমাদের মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়। মুহাদ্দিস সাহেব রহ. ছিলেন এ ব্যাপারে
যথেষ্ট সচেতন। তাঁর মুখে কখনো কোন ইমামের ব্যাপারে অসংলগ্ন কথা আমরা শুনিনি।
বিশেষ করে “ক্বালা বা’যুন্নাস” এর আলোচনায় হযরত ছিলেন খুবই সংযত। তার কথায় বা ইঙ্গিতেও
ইমাম বুখারি রহ. এর সামান্যতম মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় সেরকম কিছু ছিল না।
৩.
হযরত মুহাদ্দিস সাহেব রহ. ছাত্র-জমানায় ছিলেন উস্তাদদের প্রিয়পাত্র। আল্লামা মুশাহিদ আহমদ বায়মপুরী রহ. তাঁকে সবিশেষ স্নেহ করতেন। একবার
হযরত বায়মপুরী রহ. মুহাদ্দিস সাহেবের বুকে হাত চাপড়ে বললেন, ثقة ثبت (অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও সুদৃঢ়)।১ শব্দটি দ্বারা মুহাদ্দিসিনে
কেরাম হাদীসের বর্ণনাকারীদেরকে ন্যায়ানুগতা ও স্মরণশক্তির দৃষ্টিকোন থেকে সত্যায়ন করে
থাকেন। ইমাম যাহাবী ও হাফিজ যয়নুদ্দীন ইরাকী রহ.সহ অনেক উলামায়ে কেরামের নিকট এ শব্দটি
ইলমে হাদীসে সর্বোচ্চ স্থরের প্রত্যয়ন। (معجم
ألفاظ الجرح والتعديل: ٨٤)
একজন
মহান উস্তাদের তাঁর ছাত্র সম্পর্কে এ ধরণের উচ্চাঙ্গের মন্তব্য -বিশেষত ছাত্র জমানায়-
অবশ্যই তাঁর ভবিষ্যত প্রোজ্জ্বল জীবনের প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত করে। যা শুরু হয়েছিল শিক্ষক-জীবনের
গোড়া থেকেই। অর্ধশতাধিক বছর ধরে তিনি ছিলেন দরসে-হাদিসের প্রধান মসনদে।
১. (ঘটনাটি মাওলানা খলীলুর রহমান
শমশেরনগরী [মুহাদ্দিস, জামেয়া আরাবিয়া মারকাজুল উলুম, সিলেট] এর সৌজন্যে। তিনি এটি
সরাসরি মুহাদ্দিস সাহেব রহ. থেকে শুনেছেন।)
(লেখাটি “শিহাব উদ্দিন রাহিমাহুল্লাহ’র জীবন ও কর্ম শীর্ষক স্মারক”র জন্য রচিত)
কোন মন্তব্য নেই