Header Ads

ফিকহে হানাফি : পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য


নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্ব-মানবতার জন্য একটি শরিয়ত নিয়ে এসেছিলেন।  যেখানে আছে সব বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ সমাধান। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্যাতিক এমন কোন বিষয় নেই যেখানে আল্লাহ্‌ তায়ালা নবী করিম সা. এর মাধ্যমে কোন নীতি-আদর্শ বলে দেননি। পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরিফে কোন না কোনভাবে এর বিবৃতি এসেছে। কিন্তু কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যা কিছুই ঘটবে এর প্রত্যেকটি বিষয়ের আলাদা আলাদা হুকুম বর্ণনা করা অন্তত একজন মানুষের সংক্ষিপ্ত জীবনে সম্ভব ছিল না।  নবী করিম সা. তো শুধু তার সামনে ঘটে যাওয়া বিষয়ের স্পষ্ট সমাধান দিয়েছেন। তাঁর এসব সমাধানে কখনও শরয়ী হুকুমের ‘ইল্লত’ (কারণ) স্পষ্ট বিবৃত হয়েছে, কখনও অস্পষ্ট থেকেছে। 
নবী করিম সা. এর অন্তর্ধানের পর সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তবে তাবেয়িন মুজতাহিদ ওলামায়ে কেরাম যখন ফতোয়ার দায়িত্ব্য নিলেন তখন নিত্য নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে লাগলো।  তাঁরা উদ্ভুত সমস্যাকে কোরআন ও সুন্নাহে স্পষ্টরূপে বর্ণিত সমস্যার সাথে তুলনা করে সমাধান দিতে লাগলেন। যদি শরয়ি দলিলে ‘ইল্লতের’ উল্লেখ থাকে তবে তাঁরা এ ইল্লতের সাহায্যেই তুলনা করতেন। অন্যথায় প্রথমে ইজতেহাদের মাধ্যমে ‘ইল্লত’ বের করতেন এরপর নতুন সমস্যার সাথে এর তুলনা করতেন। তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকতো যে, তাঁর ইজতেহাদি সমাধান যেন রাসুলুল্লাহ সা. এর সমাধানের যথাসম্ভব নিকটতর হয়। 
ইসলামি স্বর্ণযুগের এসব মুজতাহিদিন উলামায়ে কেরাম মুসলিম বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। প্রত্যেকেই ছিলেন নিজ নিজ এলাকায় সাধারণ মুসলিম জনতা কর্তৃক সমাদৃত অনুসৃত। স্বর্ণযুগের ইসলামি সমাজ এভাবেই চলছিল। এ সকল মুজতাহিদ উলামায়ে কেরামের মধ্য থেকেই ছিলেন চার মাজহাবের ইমামগণ। তাদের ছাত্ররা তাদের মূলনীতির আলোকে নিত্য নতুন সমস্যার সমাধান করেছেন। এবং এবিষয়ে বিভিন্ন কিতাব রচনা করেছেন। এমনকি ততপরবর্তি কয়েক যুগে ইসলামি জ্ঞানের ছাত্ররা ব্যাপকভাবে তাঁদের কাছে ভিড়তে লাগলেন। এভাবে তাঁদের শাগরিদ-অনুসারিদের সংখ্যা ক্রমে ক্রমে বাড়তে লাগলো, এবং তাঁরা গ্রামে-গ্রামে, শহরে-শহরে তাঁরা ছড়িয়ে পড়লেন। এক সময় ফিকহ-ফাতাওয়ার গুরুভার শুধু তাঁদের হাতেই ন্যস্ত হল। এবং চার মাজহাবের ইজতিহাদি মাসায়িল ইসলামি বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি লাভ করলো। তাঁদের এ সংখ্যাধিক্য ও অগণিত অভিনব ফিকহি রচনা-সংকলন মূলত চার মাজহাবকে পৃথিবীর বুকে আধিপত্যের সাথে ঠিকিয়ে রাখতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। 
চার মাজহাবের মধ্যে হানাফি মাজহাবই মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশ তথা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান মালদ্বীপসহ ইরান, ইরাক, কাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজিস্তান, আজারবাইজান, তুরস্ক, তাজিকিস্তান, সিরিয়া, জর্ডান, উজবেকিস্তান ইত্যাদি দেশগুলিতে এককভাবে হানাফি মাজহাবেরই অনুস্বরণ করা হয়। 
 هداية الساري إلى دراسة البخاري للعلامة المحقق المحدث ٗ:١/ ٥٥٣ 


মাজহাব : শাব্দিক অর্থঃ مذهب শব্দটি فتح يفتح এর মাসদার الذهاب থেকে اسم الظرف এর সিগাহ। মূলবর্ণ ذ هه ب। এই মূলবর্ণের শব্দ মৌলিক দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। 
১. الحسن والنضارة অর্থাৎ সৌন্দর্য, উজ্জ্বল্য। 
২. والمضي السير والمرور অর্থাৎ যাওয়া, অতিবাহিত হওয়া, চলা। 
এগুলো আবার দু রকম হতে পারে, বাস্তবার্থে- যেমন ذهب فلان إلى المسجد অমুক মসজিদে গেল। রূপকার্থে- যেমন, فلان ذهب إلى قول أبي حنيفة অমুক আবু হানিফার মত গ্রহণ করেন। এই শেষোক্ত রূপক অর্থ থেকে মাযহাবকে মাযহাব বলা হয়। 
পারিভাষিক অর্থ: 
هو ما اختص به المجتهد من الأحكام الشرعية الفرعية الاجتهادية المستفادة من الأدلة الظنية.) غمز عيون البصائر في شرح الأشباه والنظائر -أحمد بن محمد الحنفي الحموي ١/٤٠) 
অর্থাৎ অনুমানিক প্রমাণ থেকে উৎসারিত শরীয়তের শাখাগত ইজতেহাদ-নির্ভর হুকুম-আহকাম, যেগুলিকে কোন মুজতাহিদ ইমামের সাথে সম্পৃক্ত করা হয় তার সমষ্টিকে মাযহাব বলা হয়। সংজ্ঞা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ইজতিহাদি মাসয়ালাগুলোই শুধু মুজতাহিদের মাযহাব হিসেবে গন্য হবে। কোরআন সুন্নাহ থেকে অকাঠ্যভাবে প্রমাণিত মাসায়িল মুজতাহিদের মাজহাব রূপে গণ্য হবে না। তেমনি ইজমা দ্বারা সাব্যস্থ আহকামও কোন নির্দিষ্ট ইমামের দিকে সম্পৃক্ত করা হবে না।
(حاشية الدسوقي:١/ ١٩ أصول الإفتاء للعثماني : ١٨)
আর যে মাসাইল মাযহাবের পরবর্তী উলামায়ে কেরাম ইমামদের উসুলেরর ভিত্তিতে বের করে গেছেন সেগুলোও মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং মুজতাহিদের নিজের উদ্ভাবিত এবং তার মূলনীতির ভিত্তিতে পরবর্তীতে বের করা মাসাইলও মাযহাবের সংজ্ঞায় ধর্তব্য। 
الانصاف للدهلوي:٩٢ حجه الله البالغة للدهلوي ١/١٦٠ 

হানাফি মাযহাব : حنفي শব্দটিأبو حنيفة এর দিকে সম্পৃক্ত। এটি ইমাম আ’জমের কুনিয়াত তথা উপনাম ছিল। এরকম শব্দকে সম্বন্ধবাচক শব্দে রূপান্তরিত করতে হলে প্রথমেأبو শব্দকে বিলুপ্ত করা হয়। এরপর فَعِيْلَةٌ এর উজনের শব্দকে মুতাল বা মযাআফ فَعَلِيٌّ এর উজনে নিসবতি (সম্বন্ধবাচক) শব্দে রূপান্তরিত করা হয়। 

ফিক্বহে হানাফি : হানাফি ফিক্বহ হিসেবে যে সকল মাসায়িল সংকলন করা হয়েছে তন্মধ্যে ইমাম আবু হানিফার প্রত্তক্ষ বক্তব্যের তুলনায় তাঁর শাগরিদ ও ততপরবর্তি হানাফি আলেমদের উদ্ভাবিত মাসায়িলই বেশি। ইমাম আবু হানিফার শাগরিদদের অনেকেই ইজতেহাদের স্তরে উন্নিত হওয়া সত্তেও আবু হানিফা রহ. এর ছায়াতলে অবস্থান করাকে নিজের জন্য নিরাপদ মনে করেছেন। তাঁরা অনেক মাসয়ালায় ইমাম সাহেবের সাথে মতানৈক্যও করতেন। তাঁদের এসকল ভিন্নমতও সমান গুরুত্বের সাথে ইমাম আবু হানিফার মতামতের পাশে লিখা হত। এবং এগুলোকেও মাজহাবে গণ্য করা হত। এছাড়া পরবর্তিতে যুগে যুগে অনেক ইজতিহাদি মাসায়িল হানাফি ফিক্বাহবিদরা ইমাম আবু হানিফা ও তাঁর ছাত্রদের মূলনীতির উপর ভিত্তি করে ইস্তিম্বাত (উদ্ভাবন) করে গেছেন বা তাঁদের থেকে বর্ণিত ফুরুআ’ত (শাখাগত মাসায়িল) এর উপর কিয়াস করে যে সব নিত্য নতুন মাসায়িল বের করেছেন সেগুলোকেও হানাফি মাজহাবের অন্তর্ভূক্ত গণ্য করা হয়। 
التقرير والتحبير لابن أمير الحاج: ٣/٣٤٦ فواتح الحموت للأنصاري: ٢/٤٠٤ شرح عقود رسم المفتي لابن عابدين: ٦٧-٦٨ 
সুতরাং ফুরুয়ি (শাখাগত) ইজতিহাদ-নির্ভর মাসায়িলের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা রহ. ও তাঁর মুজতাহিদ শিষ্যদের মতামত, তদ্রূপ তাঁদের অনুসৃত কাওয়ায়িদ ও মূলনীতির উপর ভিত্তি রেখে এবং তাঁদের প্রণিত শাখাগত মাসায়িলের উপর কিয়াস করে তাঁদের অনুসারি অন্যান্য যুগশ্রেষ্ট উলামায়ে কেরাম যে সকল হুকুম-আহকাম উদ্ভাবন করেছেন সেগুলোই মাজহাব। 
المذهب الحنفي مراحله وطبقاته.. :١/٣٩

ফিক্বহে হানাফির বৈশিষ্ঠ্য : চার ইমাম ও তাদের ছাত্রদের যমানা প্রায় কাছাকাছি হওয়ার কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চার মাযহাবের যথেষ্ট মিল রয়েছে। ইমাম আবু ইউসুফ, মুহাম্মদ রহ. সহ ইমাম আবু হানিফার অন্যান্য শাগরেদরা একদিকে ইমাম মালিক রহ. থেকে ইলম হাসিল করেছিলেন। অন্যদিকে তাদের থেকে ইমাম শাফেয়ি, আহমদ ইবনে হামবল রহ. ইলম ও ফিকহ অর্জন করেছিলেন। তাছাড়া চার মাযহাবেই কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস শরিয়ার দলিল হিসাবে গণ্য। এসব কারণে সাধারণত একটি মাযহাব কোন বৈশিষ্টে ওতপ্রোতভাবে বিশিষ্ট হয় না। তবে হানাফী মাযহাব অনেক বিষয়ে অন্যান্য মাযহাব থেকে অনন্য ও বৈশিষ্ট্যময়। 
দ্বিতীয়ত, এক মাযহাবের তুলনায় অন্য মাযহাবে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য বেশি স্পষ্ট হতে পারে। এই দু ধরণের বৈশিষ্ট নিয়ে এখানে আলোচনা হবে। 

১. কোরআনকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান এবং অন্যান্য দলিলগুলোর যথাযোগ্য মূল্যায়ন : ফিক্বহে হানাফীতে পবিত্র কোরআনকে সর্বোচ্চ দালিলিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কোরআন ও খবরে মুতাওয়াতির থেকে উৎসারিত উসুল ও মূলনীতি থেকে হানাফী ফিকাহ সামান্য নড়তেও নারাজ। কোরআনের ব্যাপকতাকেও কোন খবরে ওয়াহিদ দ্বারা শর্তযুক্ত করা হয় না। 
 هداية الساري إلى دراسة البخاري:٢/ ٣٨١ 

২. খবরে ওয়াহিদ গ্রহণে সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন : ইমাম আবু হানীফা রহ. হাদিস গ্রহণ ও বর্ণনার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ মাত্রার স্মরণশক্তির শর্তারোপ করতেন। তিনি বলেন,
لا ينبغي للرجل أن يحدث من الحديث إلا بما حفظه يوم سمعه إلى يوم يحدث به وذلك حتى لا يقول من شاء ما شاء. (مقدمة أوجز المسالك لزكريا الكاندهلوي:٦٠، مكانة الإمام أبي حنيفة بين المحدثين للحارثي:٥٢٥) 
কারো জন্য অর্জনের দিন থেকে নিয়ে বর্ণনার দিন পর্যন্ত স্মরণ রাখা ছাড়া কোন হাদিস বর্ণনা করা উচিত নয়। যাতে যে কেউ যা ইচ্ছা তা বলতে না পারে। খবরে ওয়াহিদ গ্রহণের জন্য হানাফী উলামায়ে কেরাম অনেকগুলি শর্ত আরোপ করেন। 
(ক) খবরে ওয়াহেদ কুরআন, খবরে মুতাওয়াতির, বা মাশহুরের স্পষ্ট নস বা এ থেকে উৎসারিত মূলনীতির বিপরিত না হতে হবে। 
(খ) খবরে ওয়াহেদ সাহাবায়ে কেরামের জমানায় দলিল হিসেবে পরিত্যাজ্য না হতে হবে। 
(قواعد في علوم الحديث للتهانوي:١٢٦) 
(গ) ফক্বিহ কোন সাহাবীর খবরে ওয়াহিদের বিপরীত আমল না হতে হবে। যার কাছে এমন হাদিস গোপন থাকার কথা নয়।  তেমনি খাইরুল কুরুন তথা ইসলামী স্বর্ণযুগে যদি হাদীসটির উপর আমল না পাওয়া যায় তবে এটি গ্রহণযোগ্য হবে না। তখন হাদীসটিকে মানসুখ বা ওয়াজিব সাব্যস্থকারী নয় ধরা হবে। 
(أصول السرخسي:٢/٧) 
(ঘ) বর্ণনাকারী বর্ণনা করার পর খবরে ওয়াহিদকে যদি অস্বীকার করেন তখনও এটি দালিলিক গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। কারণ রাবী নিজের বর্ণনাকে অস্বীকার করলে হাদিসের ইত্তেসাল ব্যাহত হয়। 
(أصول السرخسي:٢/٣) 
(ঙ) খবরে ওয়াহিদ এর বর্ণনাকারীর আমল বা ফাতাওয়া তাঁর বর্ণিত রেওয়ায়েতের বিপরীত না হতে হবে। যদি জানা যায় যে তিনি হাদীসটি শোনার পর এমন আমল করেছেন বা ফাতাওয়া দিয়েছেন। 
(أصول السرخسي:٢/٥، ٦ جامع الأسرار للكاكي:٣/٧٦٩) 
(চ) খবরে ওয়াহিদ এমন কোন বিষয় সম্বলিত না হওয়া যা মতবিরোধহীন কোন মূলনীতির প্রতিকূলে যায়। 
(مقدمة أوجز المسالك:٦٦ نقلا عن الخيرات الحسان للهيثمي ١٠٤) 
এছাড়াও আরো কিছু বিরোধপূর্ণ শর্ত রয়েছে। এ শর্তগুলি মূলত খবরে ওয়াহিদ গ্রহণে হানাফী মাযহাবের সীমাহীন সতর্কতারই পরিচায়ক। 

৩. কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক আমল করার স্বীকৃত পদ্ধতি : চার ইমামের ইজতিহাদি যোগ্যতা ও তাঁদের সংকলিত ফিক্বহের নির্ভরযোগ্যতার বিষয়ে গোটা মুসলিম উম্মাহ একমত। আল্লামা ইবনুল উযির (মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম ইয়ামনি [৮৪০ হি.]) বলেন, ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মুজতাহিদ হওয়ার উপর উম্মাহর ইজমা রয়েছে। উম্মাহর উলামায়ে কেরাম হয় তাঁর সরাসরি অনুসরণ করেছেন অথবা যারা অনুসরণ করেছেন তাঁদের উপর আপত্তি করা থেকে বিরত থেকেছেন। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এভাবেই ইজমা সম্পন্ন হয়।
 (الروض البسيم: مكانة الإمام أبي حنيفة في الحديث: ١٦٤-١٦٥)

৪. কোরআন সুন্নাহ থেকে আহরিত আহকাম ও ফিক্বহুস সালাফের উত্তম সংকলন : فقه متوارث তথা ফিক্বহের যে অংশ নবি-যুগ থেকে সাধারণ আমল হিসেবে অনুসৃত হয়ে আসছে তাঁর শ্রেষ্টতম সংকলন হল ফিক্বহে হানাফি। ইমাম আবু হানিফা রহ. প্রণিত ‘কিতাবুল আসারে’ দৃষ্টি বুলালে বিষয়টি জলজ্যান্ত প্রমাণিত হয়। 

৫. ফিক্বহ ও ফাতাওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা রহ. এর অনন্য নীতিমালা : এ বিষয়ে সহিহ সনদে ইমাম আবু হানিফা রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, 
(ক) মাসয়ালা যখন কিতাবুল্লাহয় পাই তখন সেখান থেকে গ্রহণ করি। 
(খ) কুরআনে কারিমে না পাওয়া গেলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ ও হাদিস অনুসন্ধান করি। 
(গ) এরপর সাহাবায়ে কেরামের ফাতাওয়া ও সিদ্ধান্তের শরনাপন্ন হই। 
(ঘ) যে বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের মতানৈক্য পাওয়া যায় সে বিষয়ে ইজতিহাদের মাধ্যমে যার মতামত কুরআন-সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তি মনে হয় তাই গ্রহণ করি। 
(ঙ) অন্যথায় ইজতেহাদের মাধ্যমে সমাধানে পৌছার চেষ্টা করি। তবে এক্ষেত্রে তাবেয়িনে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হই না। 
 (الانتقاء لابن عبد البر ٢٦١-٢٦٢، ٢٦٧) تاريخ بغداد ١٣/ ٣٦٨ 

৬. হাদিস যাচাইয়ের ক্ষেত্রে যুক্তি ও বুদ্ধির সার্থক ব্যবহার : ইমাম আবু হানিফা রহ. হাদিস যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রথমত দেখতেন হাদীসটির বিষয়বস্তু শরীয়তের সমন্বিত মেজাজ বা উসুল-বিরোধী কিনা। বিরোধী হলে হাদিসের উপযুক্ত কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতেন। দ্বিতীয়ত, বর্ণনাকারীর যোগ্যতাও দেখতেন যে হাদিসের বিষয়বস্তু ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদ্দেশ্য বুঝার যোগ্যতা তাঁর মধ্যে আছে কিনা। কারণ রাবি নির্ভরযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় ভুল বুঝার কারণে শব্দ পাল্টে যায় এবং দুটি বর্ণনায় বিরোধ সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সামঞ্জস্য বিধানের সুযোগ থাকে না। তখন যে বর্ণনার রাবি অধিক সংখ্যক সংখ্যক ফক্বিহ সে বর্ণনাকে ইমাম আবু হানীফা রহ. গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে রুকুর আগে পরে রফয়ে ইয়াদাইন এর হাদীসের ক্ষেত্রে ইমাম আওযায়ীর সাথে তার বিতর্কের ঘটনাটি তো সুপ্রসিদ্ধ।
 (قواعد في علوم الحديث للتهانوي:٢٤٦ منهج الحنفية في نقد الحديث:٢٧٢) 

৭. শুরাভিত্তিক ফেক্বাহ সংকলন: ফিকহে হানাফি কারো ব্যক্তিগত মতামতের নাম নয়। এটি একটি পরামর্শভিত্তিক ইজতেমায়ি ফিকাহ। ইমাম আবু হানিফার শাগরিদ ও সঙ্গী ফুকাহা ও মুজাহিদিনে কেরামের মজলিসে মাসায়িল উত্থাপিত হতো এবং এর উপর সবিস্তারে তর্ক-বিতর্ক আলোচনা-সমালোচনা হতো এমনকি একটি মাসাআলায় কয়েকদিন পর্যন্ত আলোচনা চলত। উম্মুক্ত মতামতের অবাধ সুযোগ থাকতো। কোন মাসআলায় যদি মজলিসের সাধারণ অবস্থান থেকে কারো দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতো তবে সেটাও আলাদাভাবে লেখা হতো। 
 কুরআন-সুন্নাহ, আসার-হাদিস, ফিক্বহ-ইজতিহাদ, কিয়াস, আরবি ভাষা-জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে দিকপাল মনীষীরা ছিলেন ইমাম আবু হানিফার শিষ্য ও সঙ্গী। এদের সম্মিলিত গবেষণা, আলোচনা, পর্যালোচনায় ফিকহে হানাফি সংকলিত হয়েছে। 
 সোলাইমান ইবনে মিহরানকে এক ব্যক্তি মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করলে তিনি ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মজলিসের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এঁদের জিজ্ঞাসা করুন, কারণ এঁদের নিকট যখন কোন প্রশ্ন উত্তাপিত হয়, তখন তাঁরা সম্মিলিতভাবে মতবিনিময় করেন। এবং সব বিষয় পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্তে উপনিত হন। 
جامع المسانيد أبو معيد الخوارزمي: ١/٢٧-٢٨ 
একদা ওকি’ ইবনুল জাররাহ এর মজলিশে এক ব্যক্তি বললেন, “ইমাম আবু হানিফা এখানে ভুল করেছেন”। উত্তরে ওকি’ বললেন, ইমাম আবু হানিফা কীভাবে ভুল করতে পারেন! তাঁর সঙ্গে রয়েছেন আবু ইউসুফ, যুফার ইবনে হুযাইল ও মুহাম্মদ ইবনুল হাসানের মত ফকিহ, মুজতাহিদ। হিব্বান ও মানদালের মত হাফিজুল হাদিস, ক্বাসিম ইবনে মাআ’নের মত আরবি ভাষা-বিজ্ঞানি, এবং দাউদ ইবনে নুসাইর ত্বয়ি ও ফুযাইল ইবনে ইয়াজের মত আবিদ-যাহিদ। এ রকম সঙ্গী যার রয়েছে তিনি ভুল করবেন কীভাবে! তাঁর কোন ভুল হলে তো এঁরাই তাঁকে ফিরিয়ে আনবেন। 
(جامع المسانيد السابق:٣٣)
ইমাম আসাদ ইবনুল ফুরাত রহ. (২১৩ হি.) বলেন, ইমাম আবু হানিফা রহ. এর চল্লিশজন সঙ্গী গ্রন্থসমূহ (অর্থাৎ ফিক্বহে হানাফি) সংকলন করেছেন। 
مقدمة نصب الراية : زاهد الكوثري: ١/٣٨ (رواية من أبي العوام) 

৮. বিরামহীন আলোচনা-পর্যালোচনা মাধ্যমে মাজহাবকে সুসংহতকরণ : এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা যে, মুসলিম বিশ্বে চার ইমামের সমসাময়িক অসংখ্য মুজতাহিদ ইমামদের অস্থিত্য ছিল। কিন্তু তাঁদের মাজহাব-মাশরাব পরিচিতি লাভ করেনি। এর অন্যতম একটি কারণ এটা যে, চার ইমামের শিষ্যগণ ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ মনীষী। তাঁরা মাজহাবকে অবিরাম আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে সুসংহত ও সুবিন্যাস্ত করেছেন এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা সমকালীন অন্য ইমামদের বেলায় ব্যাপকভাবে ঘটেনি। বিশেষত ব্যক্তিত্ব তৈরী করার যে গুণ ও মেজাজ ইমাম আবু হানিফার মধ্যে ছিল তা অন্য কারো মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। বিষয়টি ফিক্বহে হানাফিকে অনন্য করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। 
কিতাবুত তা’লীমে আছে, ইমাম আবু হানিফা রহ. থেকে যে সব মনীষী ফিকহে হানাফি বর্ণনা করেছেন তাঁদের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। 

৯. মুসলিম বিশ্বে কুরআন সুন্নাহর রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে গৃহীত ও স্বীকৃত : ফিকহে হানাফি মুসলিম বিশ্বে সুদীর্ঘ সময় রাজত্ব করেছে। আব্বাসি, উসমানি খেলাফাতকালে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘল শাসনামলেও ফিকহে হানাফিই ছিল রাষ্ট্রীয় সংবিধান। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আজ পর্যন্ত ফিকহে হানাফিই অধিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। এই গ্রহণযোগ্যতার কারণ হিসেবে বলা হয় যে, ইমাম আবু ইউসুফ রহ. আব্বাসি খিলাফতের ‘ক্বাযিউল ক্বুযাত’ পদ লাভ করার পর তিনি ফিকহে হানাফিকে ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করাতে সচেষ্ট হন। বাহ্যত একথাটি সঠিক মনে হলেও বাস্তবতা হল ক্ষমতা বা পদ হানাফি ফেকাহকে পরিচিতির তুঙ্গে পৌছায় নি বরং ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার ফলেই এটি মুসলিম বিশ্বের একক সংবিধানের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
 المدخل إلى الفقه الحنفي:٦٩ هداية الساري إلى دراسة البخاري:١/ ٥٥٤-٥٥٥ 
এ সুদীর্ঘ সময় ফিকহে হানাফি রাষ্ট্রীয় সংবিধান রূপে স্বীকৃত থাকায় যে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার স্পষ্ট উপলব্দি এবং তা সমাধানে যথাযথ পারদর্শিতা যতটুকু হানাফি মাজহাবের ঝুলিতে রয়েছে তা অন্য মাজহাবের নেই। 
فقہ حنفی کے امتیازات وخصوصیات (مقالہ) ابو عمار زاھد الراشدی 

১০. জনসাধারণের প্রয়োজন অনুধাবন, সহজসাধ্যতা ও সার্বজনীন উদার নীতি গ্রহণ : ইমাম আযম আবু হানিফা রহ.র সাথী-সঙ্গীরা মুসলিম উম্মাহর মানবিক প্রয়োজন ও অসহায়ত্ব পরিপূর্ণরূপে অনুধাবন করে সে অনুযায়ী নিয়ম-নীতি প্রণয়নের প্রচেষ্টা করেছেন। প্রত্যেক মাসআলা প্রজ্ঞার সাথে মানুষের কল্যাণকামিতার ভিত্তিতে গৃহীত হত। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সাথে সাথে যুগের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে তারা এমন মূলনীতি বিবৃত হত যা বিভিন্ন সমস্যায় উম্মাহের সন্তোষজনক দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম। 
হানাফি উলামায়ে কেরামের নিকট বিরোধপূর্ণ মাসআলার প্রাধান্য দেওয়ার একটি নীতি হলো, বক্তব্য যেন মানুষের জন্য অধিক উপকারী হয় বা এমন হয় যে, এর উপর মানুষের আমল রয়েছে
।(المدخل إلي الفقه الحنفي:٦٩) 
তবে বিষয়টি এমন স্থানে প্রয়োগ হবে যেখানে শরীয়তের সুস্পষ্ট কোন দলীল নেই। আল্লামা ইবনে নাজিম বলেন, 
المشقة والحرج إنما يعتبران في موضع لا نص فيه (الأشباه والنظائر لابن نجيم:١٣٨) 
কষ্ট ও সংকীর্ণতা সেখানেই বিবেচ্য হবে যেখানে শরিয়তের সুস্পষ্ট কোন দলিল নেই। 

১১. ইলমে ওহি ও আকল/বুদ্ধির ভারসাম্যপূর্ণ প্রয়োগ : হানাফী ফেকাহের গ্রহণযোগ্যতার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো, এর মধ্যে জ্ঞান ও বুদ্ধিকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ইলমে ওহী ও আকলের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে পরিপূর্ণভাবে যুক্তি ও কিয়াস থেকে ফায়দা নেওয়া হয়েছে। 
আকল তো আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ নেয়ামত। ইলমে ওহীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে যদি এর ব্যবহার হয় তবে তা এর যথোপযুক্ত মূল্যায়ন ও শুকরিয়া জ্ঞাপন। ফিকহে হানাফিতে এ বিষয়ে পরিপূর্ণ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। না তো আকল-বুদ্ধির প্রয়োজনকে অস্বীকার করা হয়েছে। আর না একে নসসে শরয়ির উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এমনকি হানাফি ফেকাহয় জয়ীফ হাদিস তথা নসসে শরয়ির সর্বনিম্ন পর্যায়কেও কিয়াসের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। 

১২. বিভিন্ন সমস্যায় ফিক্বহি কৌশল(حيلة) অবলম্বন : পরিভাষায় حيلة বলা হয় নিজের উদ্দেশ্য পূরণার্থে কোন সূক্ষ্ম পথ অবলম্বন করা। এর দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয় শরীয়তের কোন হুকুম রহিত করা, হালালকে হারাম, হারামকে হালালে রূপান্তরিত করা, কারও অধিকার বাতিল করা, কারো জন্য মিথ্যা অধিক অধিকার সাব্যস্ত করা, বা কোন ফরয-ওয়াজিবকে বিলোপ সাধন তবে তা হারাম। 
(الموافقات للشاطبي:٢/٣٧٩ ، الحيل في الشريعة لمحمد بحيرى:٢٣-٢٨) 
উলামায়ে কেরাম এ রকম কৌশলের ক্ষেত্রে কখনো বৈধতার কথা বলেননি। এখানে حيلة দ্বারা উদ্দেশ্য হল সম্ভাব্য কোন সংকীর্ণতা থেকে উত্তরণের জন্য ফিক্বহি সুযোগ গ্রহণ করা। যাতে কোন শরয়ী মূলনীতির সাথে বিরোধ নেই। অনেক গবেষক উলামায়ে কেরাম একে المخارج من المضايق (সংকট থেকে উত্তরণের পথ) বলে নামকরণ করেন। 
(الاستنباط الفقهي للدرعان:٢٢٧ ، غمز عيون البصائر للحموي:١/٣٨) 
ইমাম আবু হানিফা রহ.র হাতেই এর গোড়াপত্তন হয়েছিল। তখনকার নিত্য নতুন সমস্যা এবং তাঁর অসম্ভব তীক্ষ্ম মেধার সমন্বয়ই সংকট ও সংকীর্ণতা উত্তরণের পথ উদ্ভাবিত করেছিল। 
(سير أعلام النبلاء للذهبي:٦/٤٠١، ٤٠٢) 
ইমাম আবু হানীফা রহ. থেকে এমন অসংখ্য ঘটনা বর্ণিত আছে, যেখানে তিনি মানুষের বিভিন্ন সমস্যায় ফিকহী সূক্ষ্মতার আশ্রয় নিয়েছেন। 
আল্লামা ইবনু কায়্যিম আলজাওযিয়াহ রহ. জনৈক ব্যক্তির স্ত্রীর তালাক নেওয়ার উদ্দেশ্যে ফজর পর্যন্ত কথা না বলা এবং ইমাম আবু হানিফা রহ. কর্তৃক স্থানীয় মুয়াজ্জিনের মাধ্যমে ফজরের আগে আযান দেওয়ানোর পরামর্শের ঘটনাটি উল্লেখ করার পর বলেন, وهذا من أحسن الحيل এটি তো শ্রেষ্টতম কৌশল। 
(إعلام الموقعين لابن قيم الجوزية:٤/٢٢) 
ইমাম আবু হানিফা রহ.র পর তার সাথী-সঙ্গী ও পরবর্তি হানাফী উলামায়ে কেরাম তাঁর অনুকরণে এ ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। এক সময় এ মাসআলাসমূহ আলাদাভাবে সংকলিত হওয়া শুরু হয়। বিভিন্ন কিতাবে এ বিষয়ে আলাদা অধ্যায় রাখা হতো। এমনকি এ বিষয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে। 
(كشف الظنون لحاجي خليفة:١/٦٩٥، المبسوط للسرخسي:كتاب الحيل:٣٠/٢٠٩-٢١٥) 

১৩. সম্ভাব্য কল্পিত ফিক্বাহর (فقه تقديري) ব্যাপক অনুশীলন : সাধারণত বিভিন্ন সমস্যার ফিকহী আলোচনা করা হয় তা ঘটার পর। কিন্তু উলামায়ে কেরাম কোন কোন সময় সমস্যা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই এটি ঘটেছে ধরে নিয়ে ফিক্বহী আলোচনা-গবেষণা করেন থাকেন। একে ফিক্বহে ইফতিরাযী বা তাক্বদিরী বলা হয়।
(أبو حنيفة: حياته وعصره لأبي زهرة:٢٠٢) 
কোরআন-হাদিসে এর বিশেষ প্রকারকে নিষেধ করা হয়েছে। এজন্য অনেক উলামায়ে কেরাম এটিকে অপছন্দ করতেন। তবে জমহুর উলামায়ে কেরাম এর অনুমতি দিয়েছেন। 
(أحكام القرأن للجصاص:٢/٤٨٤)
মূলত নিষেধাজ্ঞার দুটি কারণ রয়েছে,
(ক) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর জমানায় অসংঘটিত বিষয়ের প্রশ্ন থেকে এজন্য বারণ করা হয়েছিল যেন বিষয়টি ফরজ বা হারাম হয়ে মুসলমানদের জন্য কঠিন হয়ে না দাড়ায়। কুরআনে কারীমে এসেছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَسْأَلُوا عَنْ أَشْيَاءَ إِنْ تُبْدَ لَكُمْ تَسُؤْكُمْ وَإِنْ تَسْأَلُوا عَنْهَا حِينَ يُنَزَّلُ الْقُرْآنُ تُبْدَ لَكُمْ عَفَا اللَّهُ عَنْهَا وَاللَّهُ غَفُورٌ حَلِيمٌ [المائدة : ١٠١] 
অর্থাৎ হে মুমিনগণ তোমরা এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করো না যা প্রকাশ করা হলে তোমরা কষ্টে পড়বে। তোমরা যদি কুরআন নাযিল হওয়ার সময় এসব প্রশ্ন করো তবে তা তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হবে। ইতিপূর্বে যা হয়েছে আল্লাহ তাআলা তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরা মায়েদাঃ ১০১)
(খ) যে বিষয় সংঘটিত হওয়া সম্ভব তা নিয়ে অনর্থক গবেষণা করা। 
(منهج السلف في السؤال عن العلم لعبد الفتاح أبو غدة:٢٥)
ইমাম আবু হানিফা রহ. থেকে প্রসিদ্ধ যে তিনি দূরদর্শিতা ও পূর্ণ যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে ফিক্বহে তাক্বদিরী তথা কল্পিত ফিক্বহ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করতেন। 
(أبو حنيفة حياته وعصره لابي زهرة:٢٠٢، ٢٠٣) 
বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, 
إنا نستعد للبلاء قبل نزولها فاذا ما وقع عرفنا الدخول فيه والخروج منه.
বিপদ আসার আগেই আমরা প্রস্তুত থাকি। যখন আসে তখন যাতে বুঝতে পারি, এতে কীভাবে ঢুকবো আর কীভাবে বেরিয়ে আসব। 
(تاريخ بغداد للخطيب:١٣/٣٤٨) 
তিনি তাঁর শাগরিদদের ইজতেহাদ, গবেষণা অনুশীলনের ক্ষেত্রে ফিক্বহে তাক্বদীরীর সাহায্য নিতেন। তিনি একটি মাসআলার সম্ভাব্য সকল অবস্থাকে তাদের সামনে উপস্থাপন করতেন এবং তাদের সাথে নিজেও সবগুলি অবস্থার সমাধানে গবেষণায় লিপ্ত হতেন। তার সাথী-সঙ্গী ও অনুসারী উলামায়ে কেরামও অনেক ফিক্বহে তাকদীরী সংকলন করে গেছেন। পরবর্তিতে এসব অবস্থা বাস্তবে ঘটেছে এবং তা সমাধানে বেগ পেতে হয়নি। 
(المدخل في الفقه لشبلي:١٣٥، المدخل الى الفقه الحنفي٦٨) 
তবে মাসআলার যে অবস্থা বাস্তবে ঘটা অসম্ভব তা নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়াকে আবু হানিফা রহ. খুবই অপছন্দ করতেন। এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, রোজাদারের উপর খাবার কখন হারাম হয়? তিনি বললেন, ফজর উদয় হলে। এরপর লোকটি প্রশ্ন করল, যদি ফজর মধ্যরাতে উদয় হয়? ইমাম আবু হানীফা রহ. তখন খুবই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন এবং লোকটিকে মজলিস থেকে উঠিয়ে দিলেন।
 (تاريخ بغداد للخطيب :١٣/٣٥٢) 

১৪. শাখাগত মাসআলার তাত্ত্বিক ভিত্তি বিনির্মাণ : হানাফী উলামায়ে কেরাম প্রত্যেক শাখাগত মাসআলাকে ব্যাপক নীতির আওতাভুক্ত করার প্রচেষ্টা করেন। এতে মাসআলা হয় যুক্তিগ্রাহ্য এবং মজবুত ভিত্তিসম্পন্ন। যেখানে অন্যান্য মাযহাবের চেষ্টা তাকে মাসআলাকে প্রত্যেক শাখাগত দলিলের অনুগামী করা। 
 (المدخل الى الفقه الحنفي لمحمد رشاد منصور شمس :٦٧) 

১৫. বিপুল সংখ্যক ফিক্বহী গ্রন্থ : এই অসংখ্য গ্রন্থসমূহ মর্যাদা ও গুরুত্বের বিচারে সুস্পষ্ট স্তরে বিন্যস্ত। কোন স্তরের কিতাব কতটুকু তাৎপর্যবহ, কোনটি থেকে ফতোয়া দেওয়া যাবে, কোনটি থেকে দেওয়া যাবে না, কোনটি থেকে শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে ফতোয়া দেওয়া যাবে তা খুবই সুস্পষ্ট সুবিন্যাস্থ আকারে বিবৃত আছে। 

১৬. সর্বাধিক সংখ্যক শাখাগত মাসআলার সমাহার : সর্বকালের সকল সমস্যার সমাধান কোরআন-সুন্নাহ বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু এগুলোকে কোরআন-হাদিস থেকে উদঘাটন করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। হানাফী উলামায়ে কেরাম কোরআন-সুন্নাহ থেকে এতসব মূলনীতি ও শাখাগত মাসাইল উম্মাহর জন্য রেখে গেছেন যে এর মাধ্যমে যুগে যুগে মানুষের অসংখ্য অগণিত সমস্যার সমাধান হয়ে আসছে। 

১৭. অমুসলিমদের অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণ : ইমাম আবু হানিফার রহ. মতে জিম্মি ব্যক্তি জান, মাল ও ধর্মীয় দিক থেকে একজন মুসলমানের মত সম্পূর্ণ স্বাধীন। মুসলমান ব্যক্তিকে হত্যাকারী জিম্মি থেকে যেভাবে ক্বিসাস নেওয়া হয় তেমনি জিম্মিকে হত্যাকারী মুসলমান থেকেও ক্বিসাস নেওয়া হবে। কাজী আবু যায়েদ দাবুসী বলেন,
 الأصل عند أبي حنيفة أنما يعتقده أهل الذمة ويدينونه يتركون عليه (تأسيس النظر للدبوسي:١٣) 
আবু হানিফার নিকট মূলনীতি হল, আহলে জিম্মা যে আকিদা বিশ্বাস করে এবং যে ধর্মের উপর চলে তাদেরকে এর উপর স্বাধীন ছেড়ে দেওয়া হবে। 

১৮. শরীয়তের চাহিদা-উদ্দেশ্য (مقاصد الشرع) উপলব্দিতে গুরুত্বারোপ: শাইখ আলী তানতাবী রহ. বলেন, الحنفية فلاسفة الفقهاء হানাফিরা হল ফুক্বাহাদের মধ্যে দার্শনিক । 

১৯. আসরারে শরীয়ত তথা শরয়ী হুকুম-আহকামের রহস্য ও তাৎপর্য উদঘাটনে গুরুত্বারোপ। 

২০. বাহ্যিক সাদৃশ্যপূর্ণ মাসআলার পার্থক্যের ব্যাপারে অধিক মাত্রায় কারণ ও যুক্তি প্রদর্শন। 

২১. ফাতাওয়া দানের সুস্পষ্ট নীতি এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই “মুফতা বিহি” বক্তব্যের প্রসিদ্ধি। 

২২. সর্বাধিক সংখ্যক যুগশ্রেষ্ঠ মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, সংকলক, গ্রন্থ-লেখক, মনীষী কর্তৃক সমাদৃত।
(المدخل إلى الفقه الحنفي:٦٨) 

এছাড়াও হানাফী মাযহাবের অনেক বৈশিষ্ট রয়েছে যার আলোচনা এ সামান্য পরিসরে সম্ভব নয়। এই অনন্য বৈশিষ্টগুলোর কারণেই তা যুগে যুগে শত চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে পৃথিবীর বুকে প্রায় শতকরা ৭৫ মুসলিম জনতা কর্তৃক অনুসৃত হয়ে আসছে। 

numanmaruf@gmail.com

৮টি মন্তব্য:

  1. চমৎকার লেখা। জাযাকাল্লাহ।

    উত্তরমুছুন
  2. দারুণ আলোচনা। প্রামাণ্য লেখাটির জন্য নোমান মারুফ শায়খকে ধন্যবা।

    উত্তরমুছুন
  3. আলহামদুলিল্লাহ অনেক সুন্দর আলোচনা!

    উত্তরমুছুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.