Header Ads

মহাবিস্ফোরণ-তত্ত্ব এবং আল-কোরআন


১.
এ বিশ্বকে আল্লাহ তা’য়ালা তার অসীম কুদরতে সৃষ্টি করেছেন অপার সব রহস্যে ভরপুর করে দিয়েছেন এ মহাজগতকে, যাতে তাঁর বান্দারা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। রহস্যঘন ক্ষেত্র তৈরি-পূর্বক পবিত্র কোরআনে মানবজাতিকে চিন্তা গবেষণার দিকে ডাকা হয়েছে বারবার।
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ
“নিশ্চয় আকাশরাজি ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের পরিবর্তনে নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্যে।”        (আলে ইমরান : ১৯০)
জ্ঞানার্জনের জন্যে মানুষকে ৩টি মাধ্যম দেয়া হয়েছে। ১. পঞ্চেন্দ্রিয়, ২. মেধা, ৩. ওহি।
পঞ্চেন্দ্রিয় ও মেধা মানুষের উপলব্ধি ও সংস্পর্শের সীমায় সীমিত। তাই ওহি ভিন্ন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ও উদ্ভাবন-শক্তি বস্তুর সীমানা পেরিয়ে যেতে অক্ষম। এ থেকেই প্রতিভাত হয়, মূলত বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন আর বুদ্ধিজীবীদের যুক্তি-প্রদর্শন সবই বস্তুকেন্দ্রিক। আর ইলমে ওহির মতবাদ বাস্তবকেন্দ্রিক ও শাশ্বত। ইলমে ওহি ছাড়া মানব-জীবনে স্বস্তির কোন কল্পনাও করা যায় না। ওহির মূল্য অনুধাবন ব্যতীত মানুষ জীবনের মূল্য অনুধাবন করতে অক্ষম।

২.
১৮৬৬ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন তাঁর যুগান্তকারী কয়েকটি তত্ত্ব আবিষ্কারের মাধ্যমে রসায়ন বিজ্ঞানের পূর্ববর্তী সকল সূত্রকেই পালটে দিয়েছিলেন। তাঁর সূত্রগুলি ছিল অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সূত্রসমূহের ঘোর-বিরোধী। তারপর ১৯০৫ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আপেক্ষিকবাদ ও কোয়ান্টামতত্ত্ব[1] নামে বিংশ শতাব্দীর দুই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের গোড়াপত্তন করেন। তাঁর আবিষ্কারের এক ধাক্কায় পাল্টে গেল পৃথিবীর সব হিসাব-পত্র। বলতে গেলে তিনি নতুন করে লিখলেন পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম কানুন।
বিজ্ঞানীরা বস্তুর সাহায্যে সুদূর মহাকাশের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তথ্য অনেকটা নির্ভুলভাবে বলতে পারেন। কিন্তু বাঁশ-তলার গোরস্তানের নিচে কী ঘটে যাচ্ছে তা মোটেও বলতে পারেন না। কারণ এটা বস্তুকেন্দ্রিক নয় বরং বাস্তবকেন্দ্রিক। বাস্তবকেন্দ্রিক জ্ঞান মূলত ইলমে ওহীর উপর নির্ভরশীল।

৩.
১৯২৭ সালে জর্জ এদুয়ার ল্যমেত্র্‌ সর্বপ্রথম বিগ ব্যাং তথা মহাবিষ্ফোরণ তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা দেন। এরপর টানা ৩৮ বছর গবেষণার পর ১৯৬৫ সালে এসে উইলসন ও পেলজিয়াস বিগ-ব্যাংয়ের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেন।
বিজ্ঞানীদের মতে প্রায় ১৫ মহাপদ্মকাল[2] পূর্বে নভোমন্ডল, ভূমন্ডল, চন্দ্র, সুর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, ছায়াপথ, নিহারিকা কোন কিছুই ছিল না। তখন শুধু বিরাজমান ছিল শূন্যতা। না ছিল শক্তি, না ছিল বস্তু, না ছিল সময়ের কোন অস্তিত্ব। এমন এক শূন্য অবস্থা ও শূন্য সময়ের মাঝে সহসা জ্ঞান ও বুদ্ধির অদম্য সূক্ষ্ম সময়ে সংগঠিত হয় এক মহাবিষ্ফোরণ। এ বিষ্ফোরণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হলো বস্তু, শক্তি ও সময়। যার উৎস ছিল সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এক বিন্দু। তত্ত্ব অনুসারে মহাসূক্ষ্ম সে বিন্দুতে ছিল অসীম ঘনত্ব ও উষ্ণতা। সে উষ্ণতার পরিমাণ ছিল  কেলভিন। অর্থাৎ ১ লিখে তারপরে ৩২ টি শূন্য (০) বসালে যে বিপুল সংখ্যা হবে তত ডিগ্রি কেলভিন।[3]
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ
কাফেররা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী পরষ্পর সংযুক্ত ছিল। অতঃপর আমি এদের ভেঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। আর আমি পানি থেকে প্রথ্যেক জীবিত বস্তু সৃষ্টি করেছি। (সুরা আম্বিয়া : ৩০)

আজকের এই সুবিশাল অন্তহীন মহাবিশ্বের উৎস ছিল এক সূক্ষ্মতম বিন্দু। যা সম্প্রসারিত হতে হতে প্রায় ২০ মহাপদ্ম আলোক বছর[৪] ব্যাস-সম্পন্ন মহা আকৃতি ধারণ করেছে। অথচ সৃষ্টির সুচনালগ্নে আদি মহাবিশ্ব ছিল পদার্থের সূক্ষ্মতর পরমানণুর মধ্যস্থিত প্রোটিন[৫] কনার চেয়েও শত সহস্র মহাপদ্মগুণ ক্ষুদ্র। সে সময় মহাবিশ্বের ব্যাস ছিল  cm । অর্থাৎ ১ লিখে তার পিঠে ৩৩ টি শূন্য বসালে যে সংখ্যা হবে তা দিয়ে ১ সেন্টিমিটারকে ভাগ করলে যে দৈর্ঘ্য পাওয়া সম্ভব; তার সমান। আকার হিসেবে এটি একটি পরমাণুর ১ হাজার কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ মাত্র। এ মহাবিষ্ফোরণ ঘটতে সময় লেগেছিল  সেকেন্ড। অর্থাৎ ১ বসিয়ে তার পিঠে ৪৩ টি শূন্য লিখলে যে বিরাট সংখ্যা হবে তা দিয়ে এক সেকেন্ড সময়কে ভাগ করলে যে সময় পাওয়া যাবে সে সময়টুকু।
জ্ঞাত সকল জ্ঞান ও তথ্যের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে, সহসা কোন এক মহাবিস্তার শক্তি হতে শক্তিপুঞ্জের এত তীব্র ঘনায়ন ঘটে যে, যুগপৎ সংঘটিত হয় অবশ্যম্ভাবী সেই মহাবিষ্ফোরণ; যা দুর্বার গতিতে অজানা অসীমের পানে ছুটে চলছে সেই মহীন্দ্রক্ষণ থেকে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ 
আমি মহাবিশ্বকে নিজ ক্ষমতাবলে সৃষ্টি করেছি এবং নিশ্চয় আমিই তা সম্প্রসারণকারী। [যারিয়াত: ৪৭]
অধুনা বিজ্ঞানীরা মনে করেন, একদম শূন্য অবস্থান থেকে সৃষ্টি -যা পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত সকল সূত্রকে ঘোরতরভাবে লঙ্ঘন করে- সেও সম্ভব। তবে এ সম্ভাবনা একমাত্র এক মহাতেন্দ্রীয় সত্ত্বার মহাশক্তি ও প্রভাবকে কার্যক্ষেত্রে আনয়নের মাধ্যমেই ব্যাখ্যাযোগ্য। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এ মহাতেন্দ্রীয় সত্ত্বাকে ব্যাখ্যা করতে যান না। কারণ সে সত্ত্বা বস্তুকেন্দ্রীক নন, বরং বাস্তবকেন্দ্রীক; যেখানে বিজ্ঞানীদের জ্ঞানের সামর্থ পৌছতে অক্ষম। তাদের জ্ঞানের দৌড় এখানেই শেষ, অথচ মুসলমানদের জ্ঞানের দৌড় এখান থেকেই শুরু মাত্র। কারণ তারা ইলমে ওহির অনুসারী।

وَمَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا () فَأَعْرِضْ عَنْ مَنْ تَوَلَّى عَنْ ذِكْرِنَا وَلَمْ يُرِدْ إِلَّا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا () ذَلِكَ مَبْلَغُهُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اهْتَدَى   [النجم : ٢٨ -٣٠]
“আর এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই। তারা কেবল ধারণার পেছনে চলে। বস্তুত; সত্যের ব্যাপারে ধারণা সামান্যও কাজে আসে না। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং পার্থিব জীবন ছাড়া আর কিছু কামনাই করে না, তুমি তাকে উপেক্ষা কর। তাদের জ্ঞানের দৌড় এ পর্যন্তই। তোমার প্রতিপালকই ভালো জানেন, কে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে আর তিনি ভালো জানেন, কে সুপথপ্রাপ্ত হয়েছে।”
[সুরা নজম: ২৮-২৯]



[1] গতিতত্ত্ব।
[2] ১ মহাপদ্মকাল = ১০,০০,০০০,০০,০০,০০০ (দশ লক্ষ কোটি) বছর।
[3] তাপমাত্রা পরিমাপক শব্দ।
[4] ১ আলোক বছর = আলোর গতিতে এক বছরে যতটুকু স্থান অতিক্রম করা সম্ভব।
[5] পরনাণুর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যে পদার্থ সাহায্য করে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.